সাইফুল্লাহ তারেক আটরা গিলাতলা প্রতিনিধি ঃ খুলনার ফুলতলা উপজেলার আটরা গিলাতলা ইউনিয়নের ০৬ নং ওয়ার্ডের কেডিএ আবাসিক এলাকার বাসিন্দা ব্যবসায়ী কামরুল ইসলাম মেয়ের নবম শ্রেণিতে রেজিস্ট্রেশনের জন্য জন্মনিবন্ধন সনদ প্রয়োজন। অনলাইন থেকে প্রিন্ট করে সনদ জমা দিতে হবে। কিন্তু অনলাইনে তাঁর মেয়ের সনদ পাওয়া যাচ্ছে না। তিনি গেলেন উপজেলাতে । সেখান থেকে জানানো হলো, ২০১১ সালের আগে করা সনদ বাতিল হয়ে গেছে। অর্থাৎ মেয়ের নতুন করে সনদ নিতে হবে। আর মেয়ের সনদ করতে হলে কামরুল ইসলাম নিজের ও তাঁর স্ত্রীরও জন্মসনদ করতে হবে। কামরুলের প্রশ্ন, ‘একবার একটা সার্টিফিকেট ইস্যু করার পর কি তা বাতিল করা যায়? জন্মনিবন্ধনপ্রক্রিয়া নিয়ে কামরুলের মতো এমন ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন অনেকে। জন্মনিবন্ধন প্রক্রিয়া ডিজিটাল করা হয়েছে। তবে অনলাইনে ফরম পূরণ করার পর তা প্রিন্ট নিয়ে প্রয়োজনীয় কাগজপত্রসহ আবার নির্ধারিত কার্যালয়ে যেতে হচ্ছে। এ ছাড়া কারও সংশোধনের দরকার হলে পোহাতে হয় নানা ঝক্কি।২০০৪ সালে জন্মনিবন্ধন আইন করা হয়, কার্যকর হয় ২০০৬ সালে। পাসপোর্ট ইস্যু, বিবাহ নিবন্ধন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি, ড্রাইভিং লাইসেন্স নেওয়া, জমি রেজিস্ট্রেশনসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ কাজে জন্মনিবন্ধন সনদ বাধ্যতামূলক। শুরুতে হাতে লেখা সনদ দেওয়া হতো। এরপর ২০১০ সালের শেষ দিকে এসে তা ডিজিটাল করার উদ্যোগ নেওয়া হয়। সে সময় দায়িত্বপ্রাপ্ত নিবন্ধকদের কম্পিউটার প্রশিক্ষণের জন্য সরকার আলাদা বরাদ্দও দেয়। এমনকি তাদেরকে প্রশিক্ষনও প্রদান করে , নিবন্ধকদের দায়িত্ব অবহেলার কারনে তথ্যগুলো অনলাইনে এন্টি হয়নি । এতে ভোগান্তিতে পড়ছেন কামরুল ইসলাম মতো অনেকে। পুরোনো সনদ এখন আর কোনো কাজেই আসছে না। নতুন করে সনদ নিতে হচ্ছে। কথা হয় মশিয়ালী গ্রামের বাসিন্দা ফরহাদ উদ্দিনের সঙ্গে। স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে সন্তানের জন্ম নিবন্ধন করাতে এসেছিলেন তিনি।ফরহাদ বলেন, তাদের দুজনের জন্ম নিবন্ধন আছে। তবে একজনের ইংরেজিতে অন্যজনেরটা বাংলায় হওয়ার কারণে তারা আবেদনই করতে পারছেন না।“নতুন এই সিস্টেম হওয়ার পর বিপদে পড়ছি। এখন বার্থ সার্টিফিকেট কেমনে করব বুঝতে পারছি না। এদিকে বাচ্চাকে স্কুলে ভর্তির সময়ও খুব ঝামেলা হয়ে যাচ্ছে।”ইউনিয়ন পরিষদের সুত্রে জানা গেছে , সন্তানের জন্ম নিবন্ধনের জন্য বাবা—মা দুজনের জন্ম নিবন্ধন বাধ্যতামূলক। বাবা ও মায়েরটা যদি বাংলায় হয় তাহলে সন্তান বাংলায় একটা জন্ম নিবন্ধন পাবে। আর দুটোই ইংরেজিতে হলে জন্ম নিবন্ধন পাবে ইংরেজিতে।“কিন্তু যদি দুজনেরটা আলাদা হয় তাহলে আবেদনই করতে পারবে না। দুজনেরটা এক ভাষায় করে নিতে হবে। এটা করলে সন্তান জন্ম নিবন্ধন নিতে পারবে। এ ধরনের সমস্যা অনেক হচ্ছে।”ফুলবাড়ীগেট রেললাইন বস্তির বাসিন্দা রিকশাচালক কাওসার জানান, ছেলেকে স্কুলে ভর্তি করাতে তার জন্ম নিবন্ধনের জন্য এসে বিপদে পড়েছেন। তিনি বলেন “ছেলের কার্ড করতে গেলে আমারে বলছে আগে আমাদের দুইজনের জন্মনিবন্ধন লাগব। এরপর আবার বলছে ইংরেজিতে করা লাগবে, নতুন এই নিয়ম হওয়ায় শিশুদের প্রথম শ্রেণিতে ভর্তিতে বাবা—মায়ের ভোগান্তির পাশাপাশি প্রাথমিকের সব শিশুকে উপবৃত্তির আওতায় আনা সম্ভব হবে না বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। আটরা গিলাতলার একটি বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, “আমার বিদ্যালয়ের প্রথম শ্রেণির শিক্ষার্থী প্রায় ১০০ জন। এর মধ্যে গত ২ মাসে ২৩ শতাংশ শিশুর জন্ম নিবন্ধন হয়েছে।”তিনি বলেন, “সরকারের উপবৃত্তি পেতে হলে শিক্ষার্থীর জন্ম নিবন্ধন বাধ্যতামূলক। তাই বহু বাচ্চার বাবা—মা ইউনিয়ন অফিসে গিয়ে নিজেদের জন্ম সনদ না থাকায় বাচ্চার জন্ম নিবন্ধন না করেই ফিরে আসতে হচ্ছে।জন্মনিবন্ধনে ছেলের নাম সংশোধন নিয়ে নিজের তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা জানালেন গিলাতলা ০৬ নং ওয়ার্ডের গৃহিণী সোমা আক্তার । তাঁর ছেলে একটি স্কুলে নবম শ্রেণিতে পড়ে। নামের একটি অক্ষর সংশোধনের জন্য তিন মাস ঘুরেছেন। অনলাইনে নাম সংশোধনের ফরম পূরণ করতে গিয়ে কখনো সার্ভার ডাউন হয়েছে, আবার কখনো ফরম পূরণ করে সাবমিট করার আগে সব তথ্য উধাও হয়ে গেছে। শেষ পর্যন্ত তিনি আবেদন করতে সক্ষম হন। কিন্তু হয়রানির শেষ হয়নি।তিনি জানান, আবেদন করার পর তাঁদের এক স্বজন ফুলতলা উপজেলা কার্যালয়ে খোঁজখবর নেন। সেখান থেকে তিন—চার দিন পর আবেদনটি জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে স্থানীয় সরকার বিভাগের উপপরিচালকের দপ্তরে পাঠানো হয়। শুরুতেই তাঁদের আবেদন নাকচ করে দিয়ে নতুন করে আবেদন করতে বলা হয়। নতুন করে আবার আবেদন করে দিনের পর দিন ওই কর্মকর্তার দপ্তরে ধরনা দিতে হয়। মাস দুয়েক পর নাম সংশোধন করা হয়। কিন্তু সেখানেও একটি ভুল হয়। সেই ভুল সংশোধনের জন্য তাঁকে আবার মাসখানেক অপেক্ষা করতে হয়। সোমা আক্তারের প্রশ্ন, ‘আসলে কাগজে—কলমে আমরা ডিজিটাল। বাস্তবে এখনো অ্যানালগ রয়ে গেছি। ছোট্ট একটা সংশোধনীর জন্য এত ভোগান্তি হবে কেন!’জন্মনিবন্ধন করার ৯০ দিনের মধ্যে সংশোধন করতে হলে তা নিবন্ধকের কার্যালয় থেকেই সম্ভব। এরপর উপজেলা বা জেলা প্রশাসনে গিয়ে করতে হয়। সংশোধনীর জন্য নিবন্ধকের কার্যালয় থেকে আবেদন উপজেলা বা জেলা প্রশাসনে পাঠানো হয়। সেখান থেকে অনুমোদন দেওয়া হলে নিবন্ধকের কার্যালয় থেকে তা সংগ্রহ করতে হয়। কিন্তু আবেদন দিনের পর দিন সংশোধনের জন্য পড়ে থাকে। তখন দ্রুত পাওয়ার জন্য মানুষ সংশ্লিষ্ট কার্যালয়ে গিয়ে ভিড় জমান। জন্মনিবন্ধন—প্রক্রিয়ায় সরকার আরও একটি নিয়ম যুক্ত করেছে। যাদের জন্ম ২০০১ সালের ১ জানুয়ারির পর, তাদের সনদ পেতে হলে মা—বাবার জন্মসনদসহ জাতীয় পরিচয়পত্র থাকা বাধ্যতামূলক। জাতীয় পরিচয়পত্র থাকতে জন্মসনদ কেন প্রয়োজন এই প্রশ্নও তুলছেন অনেকে।দীর্ঘদিন ধরে জন্মনিবন্ধন কার্যক্রম এর সাথে জড়িত ফুলতলা উপজেলার এমন একজন কর্মকর্তা জন্মসনদ নিয়ে নাগরিকের ভোগান্তির বিষয়ে তিনি বলেন, ২০১১ সাল থেকে যে সার্ভারে কাজ চলছিল, সেখানকার সব তথ্য এখনকার সার্ভারে স্থানান্তর করে নিলে নতুন করে কাউকে জন্মনিবন্ধন করতে হতো না। মানুষের এখন নানান রকম ভোগান্তি। কারণ, পুরোনো জন্মনিবন্ধনের নম্বর দিয়ে পাসপোর্ট করেছে বা ভিসার জন্য ব্যবহার করেছে। এখন তাদের ১৭ ডিজিট নেই। নতুন করে করলে সেই নম্বর পরিবর্তন হয়ে যাচ্ছে।এই কর্মকর্তা বলেন, আগের সার্ভারে ইংরেজি বাধ্যতামূলক ছিল। এতে বাংলার জায়গাটি অনেকে পূরণ করেননি বা ঠিকমতো করা হয়নি। তাদের এখন আবার বাংলা করার জন্য দৌড়াতে হচ্ছে। এ ছাড়া বর্তমান সার্ভারের সক্ষমতার চেয়ে ব্যবহারকারী বেশি। এতে প্রায়ই ডাউন হয়ে যাচ্ছে। নিবন্ধন ফরম ও সংশোধনীর ফরমটাই অনেকে বুঝছে না।নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আটরা গিলাতলা ইউনিয়ন পরিষদের জন্মনিবন্ধন সংশোধনি করতে আসে একজন ব্যাংকার বলেন , সংশোধনীর সমস্যাটা বেশি। এর জন্য মানুষকে নানান জায়গায় দৌড়াতে হয়। আইনের জন্য মানুষ না, মানুষের জন্য আইন। কাজটা সহজ প্রক্রিয়ায় করা যেত। এই কর্মকর্তার মতে, ডিজিটাল করতে গিয়ে জটিলতা হচ্ছে। যাদের ডিজিটাল করা নেই, তারা অনলাইনে নিজের তথ্য হালনাগাদ করতে পারবে—এমন একটা সুযোগ রাখা দরকার ছিল। অন্য একটি সুত্রে জানা যায় নিবন্ধন অনুসন্ধানের বিকল্প উপায় থাকলেও বর্তমান দায়িত্বরত কর্মকর্তাদের অসহযোগিতার কারনে দিন দিন সেবাগ্রহীতার ভোগান্তি বৃদ্ধি পাচ্ছে ।
0 মন্তব্যসমূহ