রেবেকার উত্ফুল্লিত অট্টহাসি ও রুমার মুক্তাঝরা মিষ্টি হাসিতে মেঝেতে পড়ে চায়ের কাপ ভেঙে যাওয়ার কষ্টটা নিমেষে মূছে গেল জাকেরের মন থেকে। হাসির মুগ্ধতায় রুমার গায়ে গায়ে পড়ে চমকপ্রদ অবস্থা ও প্রেমাসক্ত মেয়েটির আলতো হাতের ছোঁয়ার অনুভূতি এখনো জাকেরের মনকে আন্দোলিত করছে। রুমার তুলতুলে দেহবল্লরী জাকেরের দক্ষিণ হাতের ছোয়ায় রুমার মনেও শিহরন জাগায়। এ এক অভূতপূর্ব সুখানুভূতি যা কখনো ভোলার নয়।
গোপালগঞ্জের নিজড়া গ্রামে চৌধুরীবাড়ী আজ আনন্দ উল্লাসে মুখরিত। আজ রহমান চৌধুরীর জমজ মেয়েদের জন্মদিন। চৌধুরী বাড়ি বলে কথা, এটা কোন বিচিত্র ব্যাপার নয়। জমিদারি আমলে এভাবে চৌধুরীবাড়ী প্রায়শঃই আনন্দ উত্সব হতো। জমিদারি ভাটা পড়ার কারণে বহুকাল এরকম জাঁকজমক অনুষ্ঠান হয়ে ওঠে না। জমিদার বাড়ি ব্রিটিশ আমলে বৈশাখে খাজনা আদায়ের সময় এধরনের জাঁকজমক উৎসব-অনুষ্ঠান হতো। তখন গ্রামগঞ্জে ছিল কাঁচা রাস্তা, বিদ্যুৎ ছিল না। তবু আনন্দ উত্সবে এসবকিছু অন্তরায় ছিলনা।প্রতিটি মানুষের মনে ছিল অফুরন্ত শান্তি।তখন প্রজাদের ছিল গোলাভরা ধান,গোয়াল ভরা গরু, পুকুর ভরা মাছ।দিনভর আনন্দ ফূর্তিতে সবাই বসবাস করতো।আবার অশান্তিও কম ছিলনা অভাব দূর্ভীখ্খের সময় অনেক জমিদার প্রজাদের আপনজনের মতো ভেবে সাহায্য করতো আবার অনেক জমিদার প্রজাদের উপর জুলুম অত্যাচার চালাতো।উত্সবের সময় রাতের বেলা হ্যাজাক লাইট জ্বালিয়ে খাওয়া-দাওয়ার পাঁয়তারা, জারি সারি গানের আসর এসবছিল জমিদারি প্রথা। ছিল বিভিন্ন প্রকৃতি জমিদার।বেশিরভাগ বড় বড় জমিদারি ছিল হিন্দু সম্প্রদায়ের, বন্দোপাধ্যায়, চট্টোপাধ্যায়, গাঙ্গুলী,ও ঘোষ ইত্যাদি। আর মুসলমানের মধ্যে চৌধুরী, তালুকদার, শিকদার, খান বাহাদুর, সৈয়দ, মির্জা ইত্যাদি। এসকল জমিদারি প্রথা ছাড়াও ছিল অনেক জমিদারি প্রথা। এসব ক্ষেত্রে নিম্ন শ্রেণীর লোকেরা ও অনেকে ব্যবসার মাধ্যমে অর্থ-সম্পদের মালিক হলে নিলামে বা পাট্টামূলে জমিদারি ক্রয়-বিক্রয় করতো। তারাও হয়ে পড়তো জমিদার। জমিদারির খাজনা ইংরেজ সরকার ভোগ করতো। দেশকে মূলত পরিচালনা করতে ব্রিটিশ বেনিয়া। জমিদারদের রাজা বাদশা বা নবাবের মতো পাইক পেয়াদা লাঠিয়াল বাহিনী এসব থাকতো। খাজনা আদায়ের জন্য নায়েব, দাস-দাসী, গোমস্তা ইত্যাদি শান শওকত হাজার বছরের ইতিহাস।১৯৪৭ সালের ভারত পাকিস্তান স্বাধীন হওয়ার পরে কিছুকাল জমিদারি প্রথা ছিল। পরবর্তীতে হাজার ১৯৫০ সালে প্রজাদের আন্দোলনের ফলে জমিদারি প্রথার বিলুপ্তি ঘটে। আজ জমিদারি না থাকলেও ঐতিহ্যবাহী জমিদারবাড়িতে রয়ে গেছে তার নানাবিধ স্মৃতি। জা রহমান চৌধুরী বাড়িতে একনো বিদ্যমান।
হারিয়ে যাওয়া সে রুমা নামের মেয়েটি ও তার জমজ বোন ঝুমা তার ছোট ফুপুর কাছেই রয়েছে।আজ দুইবোন অপরূপ সাজে সজ্জিত হয়ে বসে আছে। এখনই শুরু হবে কেক কাটা অনুষ্ঠান। পার্শ্ববর্তী পাড়ার লোকজন উপস্থিত।
জাকেরদের পরিবার ও রহমান সাহেবের পরিবারের মধ্যে হারিয়ে যাওয়া রুমাকে ফিরে পাওয়া নিয়ে তাদের মধ্যে আসা-যাওয়া অনেক ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠছে।
।
এ ঘনিষ্ঠতা খুবই মজবুত। তাই জাকেরের মা জাহেদা বেগম ও জাকেরের পিতা আবু জাফর সবাই এসেছে। সবাই অনুষ্ঠানে যোগদান করেছে শুধু আসতে পারেনি জাকের। কারণ তার এক বন্ধু মোটরসাইকেলে অ্যাকসিডেন্ট করে হসপিটালে ভর্তি,ঔষধপত্র, ডাক্তার ইত্যাদি জকেরকেই সামলাতে হচ্ছে। তাই সে আসতে পারে নি। রুমা বহুবার তার পথ চেয়ে ক্লান্ত। বার বার ফোন করেও জাকেরকে পাওয়া যাচ্ছে না, ফোন বন্ধ।
রহমান চৌধুরীর ছোট বোন বাড়ির বারান্দায় সেই পুরনো আমলের পিতামহের ইজি চেয়ারে বসে দেখছে অনুষ্ঠান। এখনই কেক কাটা হবে। সন্ধ্যা আগত প্রায়, গুলশান আরা য়ে চেয়ারটিতে বসেছিল সেটি ছিল সেগুন কাঠের তৈরি।বহুকালের হলেও আজও অটুট আছে। যদিও দুবার বুনন সংস্কার করা হয়েছে, এই চেয়ারটাতে বসে প্র পিতামহ রুপার তৈরি হুক্কায় লম্বা নলে তামাক টানতো। সুগন্ধিযুক্ত তামাজ দিয়ে আগুন ধরিয়ে দিতো গোমস্তা।সে গোমোস্তা আর নেই। আছে তার বংশধর সেলিম। মাস্টার্স পাস করে বিদেশী সংস্থায় চাকরি করে। দেশে অনেক জায়গা জমি করে বিশাল ধনী ব্যক্তি। পার্শ্ববর্তী পাড়ায় বাড়ি। বাড়ি তো নয় যেন রাজপ্রাসাদ। বর্তমান সমাজে ধনাঢ্য ব্যক্তিরা বেশিরভাগ নিম্নবিত্ত পরিবার থেকে উঠে এসেছে। গুলশানারাকে ফুপু বলে সালাম করে বলল সেলিম। ফুফু কখন এসেছেন? গুলশানারা অবাক হয়ে বলল তুমি কে? আমি চুন্নুর ছেলে সেলিম। ও চিনেছি। হ্যাঁ তবে চুন্নুর পিতা একসময় এবাড়ীর গোমস্তা ছিল । গুলশানারা বলল তুমি তাহলে ওই,, হ্যাঁ ফুপু আমি সেই গোমস্তা বাড়ির ছেলে সেলিম। তাই বলো, শুনেছি তুমি মাষ্টারস পাস করেছ। হা ফুফু আমি সেই সেলিম। বল কেমন আছো?জি ভালো। সবই আপনাদের দোয়া ও আশীর্বাদ।
এভাবেই অনেক নিম্নবিত্ত থেকে ধনী হওয়ার গল্পের শেষ নেই। আবার ধনি থেকে গরীব হওয়া, এমনকি ভিক্ষাবৃত্তিতে পর্যবসিত হওয়া এ সমাজে অনেক রয়েছে। সৃষ্টির খেয়ালী খেলাঘরে উত্থান-পতন মানুষের জীবনে জোয়ার ভাটা নিরন্তর আবহমানকাল ধরে চলছে চলবে। আভিজাত্যের অহংকার ধনী-গরিবের ভেদাভেদ এটা কিছু ব্যতিক্রম নয়।
চলবে,,,,,
0 মন্তব্যসমূহ