মোঃসবুজ আহমেদ জীবন, জেলা প্রতিনিধি,হবিগঞ্জ :
আজ রবিবার, ৪ঠা এপ্রিল, ঐতিহাসিক তেলিয়াপাড়া দিবস। ১৯৭১ সালের এই দিনে হবিগঞ্জ জেলার মাধবপুর উপজেলার তেলিয়াপাড়া চা বাগানের ম্যানেজার বাংলোয় স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রথম বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছিল। সেনাবাহিনী, ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট, ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস, আনসার ও পুলিশ বাহিনীর উচ্চপদস্থ বাঙালি সদস্যরা উক্ত বৈঠকে মিলিত হয়ে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে এক সম্মিলিত প্রতিরোধ গড়ে তুলার পরিকল্পনা করেনন। এই বৈঠকেই প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদের নির্দেশে সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান জেনারেল এম এ জি ওসমানী মুক্তিযুদ্ধকে সুষ্ঠভাবে পরিচালনার জন্য সমগ্র রণাঙ্গণকে ১১টি সেক্টর, ৬৪টি সাব-সেক্টরে ভাগ করেন। প্রতিটি সেক্টরে ১জন সেক্টর কমান্ডার ও ৬৪ টি সাব-সেক্টরে ৬৪ জন সাব-সেক্টর কমান্ডারও নিযুক্ত করা হয়।পাশাপাশি ৩টি বিগ্রেড ফোর্স গ্রঠণ করে সেনাবাহিনির ৩ জন উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা অধীনে দেওয়া হয়। তাছাড়া অস্ত্রের যোগান, আন্তর্জাতিক সমর্থনসহ সকল গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় এ সভায়। প্রতিবছর ৪ঠা এপ্রিল হবিগঞ্জ জেলার মাধবপুর উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ও স্থানীয় আওয়ামীলীগের উদ্যোগে নানা অনুষ্ঠানমালার আয়োজন করা হয়। এবারও দিনটিকে জাতীয়ভাবে তেলিয়াপাড়া দিবস হিসেবে ঘোষণার দাবিতে বিভিন্ন কর্মসূচি নেওয়া হয়েছিল, কিন্তু করোনা মহামারীর কারনে সকল কর্মসূচী স্থগিত করা হয়েছে। ১৯৭১ সালের ৪ঠা এপ্রিল যে বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছিল সেখানে উপস্থিত ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক কর্নেল আতাউল গণি ওসমানী, তৎকালীন মেজর সিআর দত্ত, মেজর জিয়াউর রহামন, কর্নেল এমএ রব, রব্বানী, ক্যাপ্টেন নাসিম, আব্দুল মতিন, মেজর খালেদ মোশাররফ, কমান্ডেন্ট মানিক চৌধুরী, ভারতের ব্রিগেডিয়ার শুভ্রমানিয়ম, মৌলানা আসাদ আলী, লে. সৈয়দ ইব্রাহীম, মেজর কেএম শফিউল্লাহসহ প্রমুখ উর্ধতন কর্মকর্তাগণ। জেনারেল এমএজি ওসমানীর নেতৃত্বে নেওয়া হয় মুক্তিযুদ্ধের সর্বাত্মক প্রস্তুতি। শপথ বাক্য পাঠ করানোর পর নিজের পিস্তল থেকে ফাঁকা গুলি ছোড়ে স্বাধীনতা যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার শপথের আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করেন এম এ জি ওসমানী। ওই সভায় ১০ই এপ্রিল দ্বিতীয় বৈঠক ও সরকার গঠনের প্রস্তাবও করা হয়েছিল। কিন্তু নিরাপত্তার কারণে তা আর হয়ে ওঠেনি। ৩নং সেক্টর কমান্ডার মেজর কেএম শফিউল্লাহ তার হেড কোয়ার্টার স্থাপন করেন তেলিয়াপাড়া চা বাগানে। সড়ক ও রেলপথে বৃহত্তর সিলেটে প্রবেশের ক্ষেত্রে মাধবপুর উপজেলার তেলিয়াপাড়ার গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। এখান থেকে মুক্তি বাহিনী বিভিন্ন অভিযান পরিচালনা করা ছাড়াও তেলিয়াপাড়া চা বাগানে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি বড় প্রশিক্ষণ ক্যাম্প গড়ে উঠে। মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক জেনারেল এমএজি ওসমানীসহ কয়েকটি সেক্টরের কমান্ডাররা বিভিন্ন সময়ে তেলিয়াপাড়া সফর করেন। ম্যানেজার বাংলোসহ পার্শ্ববর্তী এলাকা ছিল মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক ও সেনানায়কদের পদচারণায় মুখরিত। ১৯৭১ সালের ২১শে জুনের পরে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আক্রমণের কারণে তেলিয়াপাড়া চা বাগানে স্থাপিত সেক্টর হেড কোয়ার্টার তুলে নেওয়া হয়। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ২, ৩ ও ৪নং সেক্টরে শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের স্মরণে তেলিয়াপাড়া চা বাগান ম্যানেজার বাংলোর পাশে নির্মিত হয় বুলেট আকৃতির মুক্তিযুদ্ধের প্রথম স্মৃতিসৌধ। ১৯৭৫ সালের জুন মাসে এ স্মৃতিসৌধের উদ্বোধন করেন তৎকালীন সেনাপ্রধান মেজর জেনারেল শফিউল্লাহ। তবে জায়গাটি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ স্থান হলেও এটি সংরক্ষণের কোনো উদ্যোগ ছিলো না দীর্ঘদিন ধরে। ২০১১ সালের ৭ই মে মুক্তিযোদ্ধাদের এক সমাবেশে ১০ কোটি টাকা ব্যয়ে মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্স করার কথা ঘোষণা করা হয়।পাশাপাশি ১০০ একরের এই কমপ্লেক্সে বিভিন্ন রকমের ভাস্কর্য করার কথাও ছিল। কিন্তু ন্যাশনাল টি কোম্পানির বাধার কারণে সেই প্রকল্পের কোন অংশই আজও বাস্তবায়ন হয়নি। এরমধ্যে ন্যাশনাল টি কোম্পানি স্মৃতিসৌধটিকে পৃথক করে ফেলে এবং ঐতিহাসিক বাংলোটিকে বাউন্ডারি দিয়ে আলাদা করে ফেলেছে। এক সময় সেখানে বেড়া থাকলেও ছিল একটি পকেট গেট। কিন্তু বর্তমানে চারদিকে দেয়াল থাকায় কেউ আর স্বচক্ষে দেখতে পারেন না বাংলোটি। এ নিয়ে মুক্তিযোদ্ধা ও সাধারণ মানুষের মাঝে রয়েছে চরম ক্ষোভ। বর্তমান সরকার দেশের সকল মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি বিজরিত স্থানকে সংরক্ষণের উদ্যোগ নিচ্ছে। কিন্তু রহস্যজনক কারণে তেলিয়াপাড়ার বিষয়ে এখনও কোনো কাজই হয়নি।
0 মন্তব্যসমূহ